মতৈক্য প্রতিষ্ঠায় হিমশিম খাচ্ছে ঐকমত্য কমিশন

ডেস্ক রিপোর্ট
২ জুলাই ২০২৫, ৪:২২ পূর্বাহ্ণ

আশা-হতাশার দোলাচলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় হিমশিম খাচ্ছে তারা। দফায় দফায় আলোচনা হলেও মেলাতে পারছে না সংস্কারের হিসাবনিকাশ। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে প্রত্যাশিত ঐকমত্য হচ্ছে না।

কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হলে অন্যটা আবার পিছিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষ, সাংবিধানিক পদসহ নানা বিষয়ে ঐকমত্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। অবশ্য কমিশন দাবি করেছেন, তারা আশাবাদী এবং আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমাধানে পৌঁছাতে পারবে।

সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর গঠিত পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর নিয়ে রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্ব ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কমিশনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। কমিশন প্রথম ধাপে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, সিপিবি, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টিসহ ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে পৃথকভাবে ৪৫টি বৈঠক করে। দ্বিতীয় ধাপে দলগুলোর সঙ্গে যৌথ আলোচনা শুরু করে কমিশন। ইতোমধ্যে সাতটি যৌথসভা করেছে। আজ বুধবার হবে অষ্টম বৈঠক।

যৌথ আলোচনায় কিছু ক্ষেত্রে একমত হলেও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে একমত হতে পারছে না। দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর সংস্কার কমিশনও কিছু ক্ষেত্রে তাদের আগের প্রস্তাব থেকে সরে এসে নতুন প্রস্তাব তুলে ধরেছে। তবে, কোনো কোনো দল এই নতুন প্রস্তাবও গ্রহণ করতে নারাজ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিছু সংশোধনী সাপেক্ষে ৭০ অনুচ্ছেদে দলগুলো একটি ঐক্যের জায়গায় এসেছে। স্থায়ী কমিটির কয়েকটি সভাপতির পদ বিরোধী দলকে দেওয়া, ডেপুটি স্পিকারের পদটিও বিরোধী দল থেকে নির্বাচনের বিষয়ে একমত হয়েছে। সংবিধানের মূলনীতির ক্ষেত্রেও একটি জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। সংবিধানের উচ্চকক্ষে ১০০ সদস্য রাখার বিষয়ে একমত হলেও মতের মিল হয়নি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে। সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্যও ১০০-তে উন্নীত করার বিষয়ে সব পক্ষ একমত হলেও এখানেও নির্বাপণ পদ্ধতিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে দলগুলো।

অধিকাংশ দল সারা জীবনে সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের বিষয়ে একমত হয়েছে। বিএনপি এক্ষেত্রে শর্ত আরোপ করেছে। দলটির অবস্থান হচ্ছে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) বা সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটির চিন্তা বাদ দেওয়া হলেই তারা দুই মেয়াদের বিষয়ে রাজি হবে।

এদিকে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, গণসংহতি আন্দোলন, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টিসহ বেশির ভাগ দল কিছু সংশোধনী সাপেক্ষে এনসিসির পরিবর্তে নতুন প্রস্তাবিত সংবিধান ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটির বিষয়ে একমত হলেও বিএনপিসহ তিনটি দল এর বিরুদ্ধে। তাদের অবস্থান সাংবিধানিক পদগুলোতে বিদ্যমান নিয়োগ পদ্ধতির পক্ষে।

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেওয়া একাধিক দলের নেতারাও ঐকমত্য নিয়ে তাদের সংশয় প্রকাশ করেছেন। গত ২৮ জুন ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পর গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ঐকমত্যের স্বার্থে আমরা বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসছি। কিন্তু দু-তিনটি দল ‘রিজিড পজিশনে’ আছে। এভাবে চলতে থাকলে কিয়ামত পর্যন্তও শতভাগ ঐকমত্য হবে না।

এর আগে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জুও শঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ব‍্যাপক আলোচনা, বিশ্লেষণ চলছে কিন্তু কোনো বিষয়েই ঐকমত‍্য হচ্ছে না। অনেক বিষয়েই চূড়ান্ত ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি, যা খুব দুঃখজনক। আমরা যে যত কথাই বলি না কেন, জনগণ চায় আমরা একটা ঐকমত‍্যে পৌঁছাই।

আলোচনার অগ্রগতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ নিজেই। সর্বশেষ রোববার অনুষ্ঠিত সংলাপে তিনি বলেন, বিভিন্ন বিষয়ে অগ্রগতি হলেও সত্যি কথা হচ্ছে, আশাব্যঞ্জক অগ্রগতির ক্ষেত্রে তারা খানিকটা পিছিয়ে আছেন।

রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, কমিশন আপনাদের প্রতিপক্ষ না। কমিশন আপনাদেরই অংশ। আপনাদের অবস্থানের কারণে কমিশনের নমনীয়তা প্রকাশিত হয়েছে।

আগামী মাসের মধ্যে জুলাই সনদ স্বাক্ষরের সময়সীমার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, জুলাই মাসের মধ্যেই একটি জাতীয় সনদে উপনীত হওয়ার। আশা করেছিলাম, আবু সাঈদের শাহাদাতবার্ষিকীতেই সবাই মিলে সনদে স্বাক্ষর করতে পারব। খানিকটা শঙ্কিত যে, সে জায়গায় যাব না। তবে এটা আমরা বলতে পারি জুলাই মাসের মধ্যে এই প্রক্রিয়ার একটা পরিণতির দিকে যেতে হবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সূত্রে জানা গেছে, দ্বিতীয় দফার বৈঠকে আলোচনার জন্য ২০টির মতো ইস্যু নির্ধারণ করে কমিশন। এর বেশির ভাগই সংবিধান সংক্রান্ত। এর মধ্যে সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ, স্থায়ী কমিটির সভাপতি মনোনয়ন, প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার সর্বোচ্চ সময়, নারী প্রতিনিধিত্ব, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ (নিম্নকক্ষ ও উচ্চ কক্ষ), প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া, রাষ্ট্রের মূলনীতি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, এনসিসি গঠন কাঠামো নিয়ে আলোচনা ইতোমধ্যে হয়েছে।

আজ বুধবার দ্বিতীয় দফার অষ্টম দিনের বৈঠকে নির্বাচনি এলাকা নির্ধারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের পাশাপাশি আগের বৈঠকের অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে আলোচনা হবে। এর বাইরে সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি, জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রক্রিয়া, স্থানীয় সরকারে নারী প্রতিনিধিত্ব, জেলা সমন্বয় কাউন্সিল গঠন নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে।

জানা গেছে, গতকাল নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশন বৈঠক করেছে। ওই বৈঠকে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন, সীমানা নির্ধারণ আইনসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কার্যক্রম শুরু করা ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ১৪ আগস্ট। তবে, কমিশনের লক্ষ্য চলতি মাসের মধ্যেই তাদের কার্যক্রম শেষ করে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করা। সরকারের তরফ থেকেও এ মাসের মধ্যে জুলাই সনদে স্বাক্ষরের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ আমার দেশকে বলেন, কিছু আশঙ্কার জায়গা রয়েছে। তবে দলগুলো এগিয়ে এলে দুরূহ বা অসম্ভব কিছু নয়। সব ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে একমত না হলেও আলোচনার ভিত্তিতে আমরা একটি জায়গায় আসতে পারব বলে আশাবাদী।


এই বিভাগের আরো খবর