আত্মত্যাগ, আত্মউৎসর্গ, সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব, সাম্য, মৈত্রী, সম্প্রীতি, ভালবাসা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি ও সর্বোপরি মহান আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের সুমহান মহিমায় চিরভাস্বর কুরবানী। কুরবানী মুসলিম জীবনের ইবাদতের এক তাৎপর্যপূর্ণ গৌরবের প্রধান উৎস। আদি পিতা আদম (আঃ) ও স্বীয় পুত্র হাবিল-কাবিল এবং মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইবরাহিম (আঃ) ও আদেশ অনুগত পুত্র ইসমাঈল (আঃ) এর আত্মত্যাগের মহান স্মৃতিবিজড়িত এ কুরবানী। এ দিনটি বছর ঘুরে মুসলিম জাতির নিকট আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা-বিশ্বাস ও জীবনের সর্বস্ব উৎসর্গের মাধ্যমে মহান মহিয়ানের নৈকট্য লাভের বার্তা নিয়ে হাজির হয়।
কুরবানীর আভিধানিক অর্থ
আরবি ‘কুরবান’ শব্দটি উর্দূ বা ফারসিতে ‘কুরবানী’ রুপে রূপান্তরিত হয়েছে। যার অর্থ সান্নিধ্য, নৈকট্য। আর ‘কুরবান’ শব্দটি ‘কুরবাতুন’ শব্দ থেকে নির্গত। আরবি ‘কুরবান’ ও ‘কুরবাতুন’ উভয় শব্দের শাব্দিক অর্থ সান্নিধ্য লাভ করা, নিকটবর্তী হওয়া, নৈকট্য লাভ করা। ইসলামী শরিয়ার পরিভাষায় কুরবানী ঐ মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জন ও তার ইবাদতের জন্য হালাল কোন জন্তু যবেহ করা হয়। (মুফরাদাত লি ইমাম রাগিব; আল-কামুসূল মুহিত)
পবিত্র কুরআনে ‘কুরবানী’ শব্দটি ব্যবহার না হয়ে ‘কুরবান’ শব্দটি তিন জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে। যথা- সূরা মায়েদার ২৭নং আয়াত, সূরা আহকাফের ২৮ নং আয়াত ও সূরা আলে ইমরানের ১৮৩ নং আয়াত। অনুরূপভাবে কুরআন ও হাদীসে এর সমার্থবোধক শব্দ পরিলক্ষিত হয়। যেমন-
১. ‘নাহরুন’ অর্থে। সূরা কাউছারের ২নং আয়াতে আল্লাহ বলেন- “সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন ও কুরবানী করুন”। এ অর্থে করবানীর দিনকে ‘ইয়ামুন নাহর’ বলা হয়।
২. ‘নুসুক’ অর্থে। সূরা আনয়ামের ১৬২নং আয়াতে এসেছে- “আপনি বলূন, আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সবই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য নিবেদিত”।
৩. ‘মানসাকুন’ অর্থে। সূরা হজ্জের ৩৪নং আয়াতে বলা হয়েছে- “আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানীর বিধান রেখেছি ” ।
৪. ‘উদহিয়্যা’ অর্থে। হাদীসে এ শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়। এ অর্থে কুরবানীর ঈদকে ‘ঈদুল আযহা’ বলা হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশে কুরবানী বলতে জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ থেকে ১২/১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে হালাল জন্তু (উট, গরু, বকরী, ভেড়া প্রভৃতি) যবেহ করা বুঝায়।
কুরবানীর প্রাক-ইতিকথা
কুরবানীর ইতিহাস মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই লক্ষ্য করা যায়। কুরবানীর প্রথম ঘটনাটি ঘটে আদি পিতা আদম (আঃ) এর স্বীয় দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের মাধ্যমে। ঘটনাটির বর্ণনা কুরআনে এভাবে এসেছে- “আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শুনিয়ে দাও, যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল, তখন একজনের কুরবানী কবুল হলো এবং অন্যজনের কুরবানী কবুল হলো না। তাদের একজন বললো- আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন বললো- আল্লাহতো সংযমীদের কুরবানীই কবুল করে থাকেন”। (সূরা মায়েদা-২৭)
কুরআনে বর্ণিত হাবিল ও কাবিল কর্তৃক সম্পাদিত কুরবানীর ঘটনা থেকেই মূলত কুরবানীর ইতিহাস গোড়াপত্তন হয়েছে। তারপর থেকে বিগত সকল উম্মতের উপর এ বিধান জারি ছিল। আল্লাহ বলেন- “প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানীর বিধান রেখেছিলাম”।
কুরবানীর প্রচলন আদি পিতা আদম (আঃ) এর সময় থেকে শুরু হলেও মুসলিম জাতির কুরবানী মূলত ইবরাহিম (আঃ) এবং স্বীয় পুত্র ইসমাঈল (আঃ) এর কুরবানীর স্মৃতি অনুকরণ ও অনুসরণে চালু হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক যুগে যুগে প্রেরিত অসংখ্য নবী-রাসূলকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাদের মধ্যে ইবরাহিম (আ) প্রতিটি পরীক্ষায় পাহাড়সম ধৈর্য্য ও ত্যাগের মাধ্যমে কৃতকার্য হয়েছিলেন। এ সম্পর্কে কুরআনে এসেছে-
“যখন ইবরাহিম (আঃ) কে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতপর তিনি তা পূর্ণ করলেন, তখন তিনি বললেন- আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা বানিয়ে দিলাম ” । (সূরা বাকারাহ-১২৪)
ইব্রাহিম (আঃ) এর কুরবানী প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের বাণী-
“দু’জনেই যখন আনুগত্যে মাথা নুইয়ে দিল আর ইবরাহিম তাকে কাত করে শুইয়ে দিল। তখন আমি তাকে ডেকে বললাম- হে ইব্রাহিম! তুমিতো স্বপ্নকে সত্য প্রমাণিত করে দেখালে। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। অবশ্যই এটা ছিল একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি এক মহান কুরবানীর বিনিময়ে পুত্রকে ছাড়িয়ে নিলাম। আর আমি তাকে পরবর্তীদের মাঝে স্মরণীয় করে রাখলাম”। (সূরা সাফ্ফাত-১০৩-১০৮)
সুতরাং যুগ যুগ ধরে এই কুরবানীর পদ্ধতি প্রচলিত হয়ে আসছে। আল্লাহর নির্দেশের আলোকে ইবরাহিম (আঃ) এর ঘটনা থেকে মুসলিম জাতির কুরবানীর প্রচলন শুরু হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কুরবানীর ইতিহাস ততটা প্রাচীন যতটা প্রাচীন মানব জাতির ইতিহাস। মানবমন্ডলীর জন্য রবের পক্ষ থেকে যত শরীয়ত নাযিল হয়েছে, প্রত্যেক শরীয়তের মধ্যে কুরবানীর বিধান জারি ছিল। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদাতে এ ছিল একটা অপরিহার্য অংশ।
কুরবানীর উদ্দেশ্য
কুরবানীর দু’ধরনের উদ্দেশ্য রয়েছে। পার্থিব ও অপার্থিব। অপার্থিব উদ্দেশ্য হল- মহান আল্লাহর নির্দেশ প্রতিপালন। মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আঃ) ও সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নাতকে বুলন্দ রাখা। রাসূল (সাঃ) এর একটি হাদীসে এভাবে এসেছে- “যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে না আসে”। (ইবনে মাজাহ)
পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে দাতা রবের নৈকট্য লাভ করে থাকে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন- “আল্লাহর নিকট ওদের গোশত-রক্ত পৌঁছায় না। বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া বা খোদাভীতি”। (সূরা হজ্জ-৩৭)
সুতরাং মহান রবের সন্তুষ্টি লাভ, ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং পশু-প্রবৃত্তিকে দমন করে তাকওয়া অর্জন কুরবানীর মূল লক্ষ্য।
কুরবানীর পার্থিব উদ্দেশ্য হল পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, গরিব-মিসকিন, অভাবীদের আনন্দ দান, নিজে কুরবানীর গোশত খাওয়া ও স্বজনদেরকে গোশত খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন- “যাতে ওরা ওদের কল্যাণ লাভ করে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে তার দেয়া পশুগুলো যবেহ করার সময়। অত:পর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুস্থ-অভাবীদের আহার করা”। (সূরা হজ্জ-২৮)
কুরবানীর বিধান
কুরবানী শরিয়াত সম্মত এ ব্যাপারে ওলামায়ে কিরাম সকলেই একমত। তবে কুরবানী ওয়াজিব না সুন্নাত এ ব্যাপারে দুটি মত পাওয়া যায়।
একটি মত হল, কুরবানী ওয়াজিব। ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আওযায়ী প্রমুখের মত এটা। তাদের দলিল হল, কুরআনের বাণী- “সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন ও কুরবানী করুন”। (সূরা -কাউসার) হাদীসে রাসূল (সা) বলেন- “হে মানবমন্ডলী! প্রত্যেক পরিবারের দায়িত্ব হলো প্রতি বছর কুরবানী করা।” (ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ)
অপর মতে, কুরবানী সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালেকসহ অধিকাংশ ওলামাদের মত এটা। তবে তাঁরা আরো বলেছেন- সামর্থ্য থাকা অবস্থায় কুরবানী পরিত্যাগ করা মাকরূহ। সামর্থ্য থাকার পরও যদি কোন জনপদের লোকেরা সম্মিলিতভাবে কুরবানী পরিত্যাগ করে তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। তাদের দলিল হল- রাসূল (সা) বলেছেন- “তোমাদের মাঝে যে কুরবানী করতে চায়, জিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর সে যেন কুরবানী সম্পন্ন করার আগে তার কোন চুল ও নখ না কাটে”। (সহীহ মুসলিম)
যাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব বা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ
যে ব্যক্তির উপর নিম্নোক্ত শর্তাবলী পাওয়া যাবে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব বা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।
১. মুসলিম হওয়া : অমুসলিম ব্যক্তির উপর শরিয়তের এ বিধান প্রযোজ্য নয়।
২. স্বাধীন হওয়া : গোলাম বা দাস-দাসীর উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
৩. মুকিম হওয়া : মুসাফিরের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
৪. সামর্থ্যবান বা ধনী হওয়া : গরীব বা মিসকিনের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
উল্লেখ্য যে, কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয় বরং কুরবানীর দিন ব্যয়ের উদ্ধৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তুর নিসাব পরিমাণ মালিক হলে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব। দৈনন্দিন প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে সাত ভড়ি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্যের মালিককে নিসাব মালিক বলা হয়।
কুরবানী বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলি
কুরবানী মুসলিমদের আর্থিক ইবাদত সমূহের অন্যতম ইবাদত। আর কোন ইবাদত কবুলের পূর্ব শর্ত দুটি, যা কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। (১) ইখলাস বা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে হওয়া। যেমন সূরা মায়িদার ২৭নং আয়াতে আল্লাহ বলেন- “আল্লাহ তো মুক্তাকীদের কুরবানীই কবুল করে থাকেন”।
(২) তা যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) এর নির্দেশিত বিধি-বিধান অনুযায়ী হয়। আল্লাহ তায়ালা সূরা কাহফের ১১০ নং আয়াতে বলেন- “যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সাক্ষ্য কামনা করে, সে যেন সৎ কর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে অংশীদার না করে”।
বাহ্যিকভাবে কুরবানী সহীহ বা শুদ্ধ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে, তারমধ্যে-
১. এমন পশু দ্বারা কুরবানী দিতে হবে যা শরিয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেগুলো হলো- গরু, উট, মহিষ, ছাগল, দুম্বা, ভেড়া। কুরআনের পরিভাষায় এগুলোকে ‘বাহীমাতুল আনআম’ বলা হয়। কুরআনে এসেছে- “প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানীর বিধান করে দিয়েছি, তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে”। (সূরা হজ্জ-৩৪) গুণগত দিক দিয়ে উত্তম কুরবানীর পশু হৃষ্টপুষ্ট, অধিক গোশত সম্পন্ন, নিখুত ও দেখতে সুন্দর হওয়া।
২. শরিয়তের দৃষ্টিতে পশুর নির্দিষ্ট বয়স হতে হবে। যেমন উট পাঁচ বছরের হওয়া, গরু বা মহিষ দুই বছরের হওয়া, দুম্বা, ভেড়া, ছাগল এক বছরের হওয়া। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে- “তোমরা অবশ্যই নির্দিষ্ট বয়সের পশু কুরবানী করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের মেষশাবক কুরবানী করতে পার”। (সহীহ মুসলিম)
৩. কুরবানীর পশু যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত হতে হবে। যেমন হাদীসে এসেছে, বারা ইবনে আযেব (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূল (সা) আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন। অতপর বললেন- চার ধরনের পশু দিয়ে কুরবানী জায়েজ হবে না। অন্ধ, যার অন্ধত্ব স্পষ্ট, রোগাক্রান্ত, যার রোগ স্পষ্ট, পঙ্গু, যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট এবং আহত, যার কোন অংগ ভেঙ্গে গেছে। (তিরমিজি)
৪. ত্রুটিযুক্ত পশু দিয়ে কুরবানী করলে তা মাকরূহ হবে। যেমন শিং ভাংগা, লেজ কাটা, কান কাটা ইত্যাদি।
৫. যে পশু কুরবানী করা হবে তার উপর মালিকের পূর্ণ স্বত্ব থাকতে হবে, বন্ধকি পশু, জব্দ করা পশু বা পথে পাওয়া পশু দ্বারা কুরবানী করলে কুরবানী হবে না।
কুরবানীর নিয়মাবলী
কুরবানীর সময়সীমা
কুরবানী নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সম্পর্কিত একটি ইবাদত। এ সময়ের পূর্বে যেমন কুরবানী আদায় হবে না তেমনি পরে করলেও আদায় হবে না।
ঈদের সালাত আদায় করার পর থেকে কুরবানীর সময় শুরু হয়। সালাত শেষ হওয়ার সাথে সাথে পশু কুরবানী না করে সালাতের খুৎবা দুটি শেষ হওয়ার পর যবেহ করা উত্তম। কেননা রাসূল (সা) এ রকম করেছেন। হাদীসে এসেছে- জুনদুব ইবনে সুফিয়ান আল-বাজালী (রা) বলেছেন, “রাসূল (সা) কুরবানীর দিন সালাত আদায় করলেন অতপর খুৎবা দিলেন তারপর পশু যবেহ করলেন।” (সহীহ বুখারী)
আর কুরবানীর সময় শেষ হবে যিলহজ্জ মাসের তের তারিখের সূর্যাস্তের সাথে সাথে। সুতরাং কুরবানীর পশু যবেহ করার সময় হলো, চারদিন অর্থাৎ যিলহজ্জ মাসের দশ, এগারো, বারো, তেরো তারিখ। এ মতটিই সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য। রাসূল (সা) বলেছেন- “আইয়ামে তাশরীকের প্রতিদিন যবেহ করা যায়”। (আহমদ) আইয়ামে তাশরীক বলতে কুরবানীর পরবর্তী তিন দিন বুঝায়।
সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারা প্রমাণিত হয়, কুরবানীর পরবর্তী তিনদিন কুরবানীর পশু যবেহ করা যায়। ইবনুল কাইয়ুম (রাহ) বলেন, আলী ইবনে আবি তালিব (রা) বলেছেন- “কুরবানীর দিন হলো- ঈদুল আযহার দিন ও পরবর্তী তিন দিন”। অধিকাংশ ইমাম ও আলেমদের এটাই মত। তবে যারা কুরবানীর সময়সীমা তিনদিন (দশ, এগারো ও বারো তারিখ) বলেন, তাদের মতের সমর্থনে কোন প্রমাণ ও মুসলিমদের ঐক্যমত (ইজমা) প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
কুরবানীর গোশত বণ্টন
কুরবানীর গোশত বন্টন ও খাওয়া সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- “অতপর তোমরা তা হতে আহার করো এবং দস্থ, অভাবগ্রস্তকে আহার করাও”। (সূরা হজ্জ-২৮)
রাসূল (সা) বলেন- “তোমরা নিজেরা খাও ও অন্যকে আহার করাও এবং সংরক্ষণ করো।” (সহীহ বুখারী)
‘আহার করাও’ বাক্য দ্বারা অন্যদেরকে খাওয়ানো, দান করা বুঝানো হয়েছে। তবে কুরআন ও হাদীসে নির্দিষ্ট করে কতটুকু খাবে এবং দান করবে তা বলা হয়নি। উলামায়ে কেরাম কুরবানীর গোশত তিন ভাগে ভাগ করে একভাগ নিজের খাওয়া, এক ভাগ দুস্থ, গরিব, অভাবীদের জন্য দান করা এবং অপর ভাগ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীকে উপহার দেয়া মুস্তাহাব বলেছেন।
কুরবানীর গোশত যতদিন ইচ্ছা সংরক্ষণ করা যাবে। তিন দিনের বেশী সংরক্ষণ করা যাবে না বলে যে হাদীস রয়েছে তার হুকুম রহিত হয়ে গেছে। তবে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার ব্যাখ্যা হলো, দুর্ভিক্ষের সময় তিন দিনের বেশী সংরক্ষণ করা জায়েজ হবে না। দুর্ভিক্ষ না থাকলে যতদিন খুশি সংরক্ষণ করা যাবে।
কুরবানীতে অংশীদার হওয়া
কুরবানীতে অংশীদার হওয়া সম্পর্কে একাধিক হাদীস থেকে প্রমাণ লক্ষ্য করা যায়।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, “আমরা রাসূল (সা) এর সাথে এক সফরে ছিলাম। এমতাবস্থায় কুরবানীর ঈদ উপস্থিত হলো। তখন আমরা সাতজনে একটি গরু ও দশজনে একটি উটে শরীক হলাম। (নাসাঈ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)
জাবির (রা) বলেন, “আমরা আল্লাহর রাসূল (সা) এরসাথে হজ্জ ও উমরার সফরে ছিলাম। তখন আমরা একটি গরু ও উটে সাতজন করে শরীক হয়েছিলাম। (সহীহ মুসলিম)
মৃত ব্যক্তির পক্ষে কুরবানী
কুরবানী মূলত যথাসময়ে জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। অবশ্য ইচ্ছা করলে তার মৃত আত্মীয়-স্বজনের পক্ষ থেকেও কুরবানী করা যেতে পারে। এটা জায়েজ ও সওয়াবের কাজ। যেহেতু রাসূল (সা) ও তাঁর সাহাবাগণ নিজেদের এবং পরিবার পরিজনদের পক্ষ থেকে কুরবানী করতেন। কুরবানী একটি সদকা। মৃত ব্যক্তির জন্য সদকা ও কল্যাণমূলক কাজ প্রয়োজন ও এটা তার জন্য উপকারী। অনেক সময় দেখা যায় ব্যক্তি নিজেকে বাদ দিয়ে মৃত ব্যক্তির পক্ষে কুরবানী করেন। এটা মোটেই ঠিক নয়। ভাল কাজ নিজেকে দিয়ে শুরু করতে হয় তারপর অন্যান্য জীবিত ও মৃত ব্যীক্তর পক্ষ থেকে করা যেতে পারে। হাদীসে এসেছে- আয়েশা (রা) ও আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) যখন কুরবানী দিতে ইচ্ছা করলেন তখন দুটি দুম্বা ক্রয় করলেন। যা ছিল বড়, হৃষ্টপুষ্ট, শিংওয়ালা, সাদা-কাল বর্ণের এবং খাসি। একটি তিনি তাঁর এ উম্মতের জন্য কুরবানী করলেন, যারা আল্লাহ একত্ববাদ ও তাঁর রাসূলের রিসালাতের সাক্ষ্য দিয়েছে, অন্যটি তার নিজের ও পরিবারবর্গের জন্য কুরবানী করেছেন। (ইবনে মাজাহ)
কুরবানীর পশু যবেহ কালে লক্ষণীয় কতিপয় দিক
১. কুরবানী দাতা যদি শরিয়তসম্মত পদ্ধতিতে ভালভাবে যবেহ করতে পারেন, তাহলে নিজের কুরবানীর পশু নিজেই যবেহ করবেন। কেননা আমাদের প্রিয়নবী (সা) নিজে যবেহ করেছেন। আর কুরবানী করা আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যমে হওয়ায় প্রত্যেকের কুরবানী নিজে যবেহ করার চেষ্টা করা উচিত। তবে কুরবানীর পশু যবেহ করার দায়িত্ব অন্যকে অর্পণ করা জায়েজ আছে। কেননা, হাদীসে এসেছে- “রাসূল (সা) তেষট্রিটি কুরবানীর পশু নিজ হাতে যবেহ করে বাকীগুলো যবেহ করার দায়িত্ব আলী (রা) কে অর্পণ করেছেন।” (সহীহ মুসলিম)
২. পশুর প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করা। এমন ব্যবস্থা নিয়ে যবেহ করা, যাতে পশুর অধিক কষ্ট না হয়। যবেহ যেন খুব তীক্ষ্ম ধারালো ছুরি দ্বারা করা হয়, যাতে সহজেই প্রাণ ত্যাগ করতে পারে। বধ্য পশুর সম্মুখে ছুরি শান দেওয়া উচিত নয় (মাকরূহ)। যেহেতু নবী (সা) ছুরি শান দিতে এবং তা পশু থেকে গোপন কতে আদেশ করেছেন এবং বলেছেন- “যখন তোমাদের কেউ যবেহ করবে, তখন সে যেন তাড়াতাড়ি করে”। (ইবনে মাজাহ) একইভাবে একটি পশুকে অন্য একটি পশুর সামনে যবেহ করা এবং ছেচরে যবেহ স্থানে টেনে নিয়ে যাওয়াও মাকরূহ।
৩. কুরবানীর পশু যদি উট হয়, তাহলে তাকে বাম পা বাধা অবস্থায় দাঁড় করে নহর করতে হবে। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান অবস্থায় তাদের উপর তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর”। ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, এর অর্থ হল তিন পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবে আর সামনের বাম পা বাধা থাকবে। (তাফসীরে ইবনে কাসির)
৪. যবেহ কালে পশুকে কিবলামুখী করে শয়ন করাতে হবে। অন্যমুখী শুইয়েও যবেহ করা সিদ্ধ হবে। যেহেতু কিবলামুখী করে শুইয়ে যবেহ করা ওয়াজিব হওয়ার কোন শুদ্ধ প্রমাণ নেই। (আহকামুল উযহিয়্যাহ)
৫. যবেহ করার সময় বিসমিল্লাহ বলতে হবে। কারণ এটা বলা ওয়াজিব। কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়নি তা হতে তোমরা আহার করো না, এটা অবশ্যই পাপ”। (সহীহ বুখারী) যবেহকালীন সময়ে বিসমিল্লাহ’র সাথে ‘আল্লাহু আকবার’ যুক্ত করা মুস্তাহাব। হাদীসে এসেছে- ‘রাসূল (সা) দুটি শিংওয়ালা ভেড়া যবেহ করলেন, তখন ‘বিসমিল্লাহ’ ও ‘আল্লাহু আকবর’ বললেন’। (সুনানে দারেমী)
৬. যবেহতে রক্ত প্রবাহিত হওয়া জরুরী। রাসূল (সা) বলেছেন, “যা খুন বহায় এবং যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয় তা ভক্ষণ করো” (সহীহ বুখারী)। রক্ত প্রবাহিত ও শুদ্ধ যবেহ হওয়ার জন্য চারটি অংগ কাটা জরুরী; শ্বাসনালী, খাদ্যনালী এবং পার্শ্বস্থ দুটি মোটা শিরা।
৭. প্রাণ ত্যাগ করার পূর্বে পশুর অন্য কোন অংগ কেটে কষ্ট দেওয়া হারাম। ঘাড় মটকানো, পায়ের শিরা কাটা, চামড়া ছাড়ানো ইত্যাদি কাজ জান যাওয়ার আগে বৈধ নয়। যেহেতু পশুকে কষ্ট দেয়া আদৌ বৈধ নয়। পশু পালিয়ে যাওয়ার ভয় থাকলেও ঘাড় মটকানো যাবে না। বরং তার বদলে কিছুক্ষণ ধরে রাখা অথবা চেপে রাখা যায়। যবেহ করার সময় পশুর মাথা যাতে বিচ্ছিন্ন না হয় তার খেয়াল করা উচিত। তা সত্ত্বেও যদি কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে তা হালাল হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। যবাই ছেড়ে দেয়ার পর কোন পশু উঠে পালিয়ে গেলে তাকে ধরে পুনরায় যবেহ করা হালাল।
কুরবানীর শিক্ষা
মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ) তাঁর কলিজার টুকরা প্রিয় সন্তান ইসমাঈল (আ) কে আল্লাহর রাহে কুরবানী দেয়ার সুমহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যেভাবে ঈমানী অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মানব জাতিকে আত্মত্যাগের শিক্ষা দিয়ে গেছেন, সে আদর্শ ও প্রেরণায় আমরা আমাদের জীবনকে ঈমানী আলোয় উদ্ভাসিত করবো, এটাই কুরবানীর মৌলিক শিক্ষা। ত্যাগ ছাড়া কখনোই কল্যাণকর কিছুই অর্জন করা যায় না। মহান ত্যাগের মধ্যেই রয়েছে অফুরন্ত প্রশান্তি। কুরবানী আরো শিক্ষা দেয় যে, দুনিয়াবী সকল মিথ্যাচার, অনাচার, অবিচার, অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন, হানাহানি, স্বার্থপরতা, দাম্ভিকতা, অহমিকা, লোভ-লালসা ত্যাগ করে পৃথিবীতে শান্তি ও সাম্যের পতাকা সমুন্নত রাখতে। পশু কুরবানী মূলত নিজের কুপ্রবৃত্তিকে কুরবানী করার প্রতীক। কুরবানী আমাদেরকে সকল প্রকার লোভ-লালসা, পার্থিব স্বার্থপরতা ও ইন্দ্রিয় কামনা-বাসনার জৈবিক আবিলতা হতে মুক্ত ও পবিত্র হয়ে মহান স্রষ্টার প্রতি নিবেদিত বান্দা হওয়ার প্রেরণা যোগায় এবং সত্য ও হকের পক্ষে আত্মোৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত করে। কুরবানীর স্বার্থকতা এখানেই। তাই পশু গলার খঞ্জর চালানোর সাথে সাথে যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতা, কুফর, শিরক, বিদআত, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ, রিয়া, পরনিন্দা-পরচর্চা, পরশ্রীকাতরতা, সংকীর্ণতা, গর্ব-অহংকার, কৃপণতা, ধনলিপ্সা, গীবতের মত পশুসুলভ আচরণ সযত্নে লালিত হচ্ছে তারও কেন্দ্রমূলে ছুরি চালাতে হবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি মুহুর্তে স্রষ্টার আনুগত্য ও খোদাভীতির দ্বিধাহীন শপথ গ্রহণ করতে হবে।
সমাপ্তীলগ্নে আমরা এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, কুরবানী নিছক কোন আনন্দ-উল্লাসের উৎসব নয়, বরং আত্মত্যাগ, আত্মউৎসর্গ, আত্মসমর্পণের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত। এটি কোন কপোল-কল্পিত উপাখ্যান বা কল্পনা ফানুসের ফলশ্রুতি নয় বরং এ কুরবানীর সংস্কৃতির প্রবর্তক স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামীন। মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইবরাহিম (আ) ও স্বীয় পুত্র ইসমাঈল (আ) যে অবিস্মরণীয় ত্যাগ, আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও আনুগত্যের চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সেই স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় ও পালনীয় কল্পে কুরবানীর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আবহমানকাল থেকে চলে আসছে। শুধু পশুর গলায় ছুরি চালানোতে কোন স্বার্থকতা নেই, বরং হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, অহমিকা-দাম্ভিকতা, অবৈধ অর্থ লিপ্সা, পরচর্চা-পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতাসহ যাবতীয় মানবীয় পশুত্বের গলায় ছুরি চালাতে পারলেই কুরবানী স্বার্থকতা বয়ে আনবে।
লেখক
অধ্যক্ষ, নিবরাস মাদরাসা
পিএইচডি গবেষক।
ই-মেইল: mutasimbd@yahoo.com