শিরোনামের এই প্রশ্নটি আজ অনেকের মনেই উদয় হচ্ছে। এই হতাশা বিএনপির সুহৃদদের বিরাট অংশকে গ্রাস করছে। আর এই হতাশার আড়াল থেকে শত্রুরা আরো তুষ ছুড়ে দিচ্ছে! অনেক জায়গায় সত্যের সঙ্গে অর্ধ সত্য মিশিয়ে পরিবেশন করা হচ্ছে। কাজেই বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করা যেমন ক্ষতিকর, তেমনি পুরোপুরি এই প্রচারণায় গা ভাসিয়ে দেওয়া আরো ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনতে পারে । এতে আশঙ্কা হচ্ছে, জেদের ভাত কুকুরে খেয়ে ফেলতে পারে।
আমার আজকের এই কলামটি মূলত পিনাকীদার মনে উত্থিত একটি দার্শনিক অনুভূতির পোস্টমর্টেম বলতে পারেন। কারণ পিনাকীদার মনে উত্থিত এই দার্শনিক তত্ত্বটি অনেকের দিলে বাজছে, অনেক রক্তক্ষরণও ঘটাচ্ছে। অন্যদিকে পিনাকীদা ও ইলিয়াস হোসাইনের ভক্ত অনেকেই এখন তাদের বিশেষ করে পিনাকীদার সাম্প্রতিক কিছু ভিডিও নিয়ে খুবই টেনশনে বা মনঃকষ্টে পড়ে গেছেন। তাদের অনেকেরই প্রত্যাশা, এই ব্যাপারে আমি বোধহয় একটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হব।
আলোচনা শুরুর আগে চলুন পিনাকীদার সেই লেখাটির ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিই। গত ৩ ফেব্রুয়ারি নিজের ভেরিফায়েড পেজ থেকে রাত ৮টার সময়ে তিনি লেখেন‘অদ্য প্রাতঃকালে আমার অন্তরে এক গভীর দার্শনিক অনুভূতির উদ্ভব ঘটিয়াছে। আমরা বিএনপির নিকট কী প্রত্যাশা করিতেছি? আমরা কেনই বা তাহা প্রত্যাশা করিব? আমরা কি এক অধিকতর উৎকৃষ্ট বিএনপি প্রত্যাশা করিতেছি, যেরূপ সিপিবি এক উৎকৃষ্টতর আওয়ামী লীগ প্রত্যাশা করিত?’
‘বিএনপি যে আওয়ামী লীগের তুলনায় শ্রেয়তর, ইহাতে কোনো সন্দেহ নাই হউক তাহা দলীয় কাঠামোর দৃষ্টিকোণ হইতে, হউক তাহার রাজনৈতিক আদর্শের বিচারে। কিন্তু বিএনপি কি আমাদের স্বপ্নের সেই রাজকুমার হইতে অভিলাষী, নাকি তাহার পক্ষে তাহা হওয়া সম্ভবপর নহে?’
‘আমরা কি ধর্মীয় সেই ব্যাখ্যার মধ্যে প্রবেশ করিতেছি, যাহাতে বলা হয় যে ইহজগৎ পূর্বে অধিকতর শুদ্ধ ও পবিত্র ছিল এবং ক্রমান্বয়ে উহা কলুষিত হইতেছে? যেমন অনেকের ধারণা যে জিয়ার প্রতিষ্ঠিত বিএনপি পূর্বে উৎকৃষ্ট ছিল, আর এখন তাহা ক্রমশঃ অবক্ষয়ের পথে যাত্রা করিতেছে?’
‘বিএনপি কী হইবে, তাহা নির্ধারণের দায়িত্ব সম্পূর্ণ তাহাদেরই। আমাদের বিএনপিতে ফিরিয়া ফল কী, এই জগতে কে কাহার?’
কাজেই যে জায়গায় দাঁড়িয়ে (ইন্ডিয়ার কোলে বসে) সিপিবি একটা উৎকৃষ্ট আওয়ামী লীগ প্রত্যাশা করত, তেমনি একটা অধিকতর উৎকৃষ্ট বিএনপি আমরা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে বা একই কোলে বসে আমরা প্রত্যাশা করছি না। জনপ্রত্যাশার এই চাপকে অ্যাভয়েড বা ইগনোর করার শক্তি বর্তমান বিএনপির নেই।
বিএনপির অ্যাক্টিং চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে যতটুকু ব্যক্তিগত যোগাযোগ রয়েছে, তা থেকে আমি এই কনফিডেন্সটি পেয়েছি। অ্যাক্টিং চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমার সর্বশেষ যে যোগাযোগটি হয়েছে, যার স্ক্রিনশট আমি পিনাকীদা এবং কনক সারওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে শেয়ার করেছি। সেটি নিয়ে আলোচনার আগে বর্তমান রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপটি স্মরণ করা জরুরি। কারণ আওয়ামী লীগকে নিয়ে সিপিবির প্রত্যাশাটি ছিল বামদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাসিতা। কিন্তু বিএনপির ওপর আমাদের প্রত্যাশা আঠারো কোটি মানুষের জীবন-মরণ সমস্যার সঙ্গে জড়িত। কাজেই কোনো অভিমান বা হতাশা থেকে এই প্ল্যাটফরমটির সঙ্গে সম্পর্ক চুকানো কোনোভাবেই ঠিক হবে না।
বিএনপির কেউ নই আমি। তারপরও কিছু কথা বলতে একধরনের নৈতিক চাপ অনুভব করছি। কারণ ২০০৭/২০০৮ সালে রাজনৈতিক ভ্যাকিউম সৃষ্টির মাধ্যমে মাইনাস টু নামক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে যেভাবে দাঁড়িয়েছিলাম, আজও একই তাগিদ অনুভব করছি। দেশের দুটি দলের একটি আওয়ামী লীগের অপমৃত্যু ঘটেছে। আমার মনে হয় এক-এগারোর প্রবক্তাদের টার্গেটের অর্ধেক পূর্ণ হয়েছে। এখন বাকি অর্ধেক অর্থাৎ বিএনপিকেও ধ্বংস করার পরিকল্পনা শুরু হয়ে গেছে।
এদিকে ড. ইউনূস নিজেও জানেন না যে এই উপদেষ্টাদের কাদের পরামর্শে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ড. ইউনূস বলেছেন, যাদের কাছাকাছি পেয়েছি, তাদের নিয়েই সরকার গঠন করেছি। সহজেই অনুমিত হয় যে জাতির ‘বিশেষ কুমিরের বাচ্চাগুলোকে’ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মোড়কে ওনার চোখের সামনে পরিবেশন করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন, সরকার গঠনের আগে কুমিরের বাচ্চাগুলোকে কে বা কারা ওনার চোখের কাছে তুলে ধরেছিল?
সব খেলার পেছনের আসল খেলারাম কে?
এ কারণেই বলেছি, ছাত্রদের হাতে দু-তিনটি চকোলেট ধরিয়ে দিয়ে আসল খেলারাম এই খেলাটি খেলেছিল। তারপরও ড. ইউনূসের ব্যক্তিত্ব ও গ্লোবাল পরিচিতি এই খেলারামকে কিছুটা বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। এখন জানা যাচ্ছে ড. ইউনূস এই খেলারামদের প্রথম চয়েজে ছিলেন না। ছাত্রদের চাপে পড়ে এই কাজে বাধ্য হয়েছেন। বারবার মনে হয়, এই দেশটির ওপর আল্লাহতায়ালার এক বিশেষ রহমত সব সময় থাকে! কাজেই আমরা সবাই মিলে অ্যালার্ট বা সজাগ থাকলে ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হতে পারবে না ইনশাআল্লাহ।
এক-এগারোর প্রবক্তাদের কয়েকটি রোডম্যাপ বা প্ল্যান ছিল। প্ল্যানে বা প্রথম টার্গেট ছিল, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ উভয়কে মাইনাস করে আধিপত্যবাদের তল্পিবাহী সুশীল গন্ধযুক্ত একটা পাপেটশ্রেণি তৈরি করা। প্ল্যানে ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় রোডম্যাপের মতো আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। একদলীয় শাসনকে উন্নয়নের ফানুস দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করা হয়। স্বাধীনতার চেতনা দিয়েই স্বাধীনতাকে লুলা করে ফেলা হয়। কথিত বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো নিজেদের সব শক্তি দিয়ে এই রেজিমকে সহায়তা করে। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি! দ্বিতীয় রোডম্যাপের ঝুঁকিটুকু তাদের জানা ছিল। পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে সেভাবেই প্ল্যান-সির পরবর্তী খেলোয়াড়দের তৈরি করে। কাজেই প্ল্যান-বি ব্যর্থ হলে এক নম্বর রোডম্যাপের অর্ধেক (হাসিনা মাইনাস) বাস্তবায়িত হয়েছে জ্ঞান করে বাকি অর্ধেক (বিএনপি মাইনাস) বাস্তবায়নের চেষ্টা শুরু করেছে । এখন সেই ধাপের কাজই চলছে। এ কারণেই এদের কাছে জামায়াতের কদর বেড়ে গেছে, এক-এগারোর শুরুর সময়ের মতো।
তারপর বাকি থাকবে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামপন্থি দলগুলো। অর্থাৎ আমাদের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ হবে হুবহু মিসরের মতো। তখন ইসলামপন্থিদের থামাতে সিসির মতো কোনো পাপেটকে বসিয়ে দিলে আমেরিকাসহ সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন জোগাড় করা কঠিন হবে না! পশ্চিমা বিশ্বের মনে তখন অটোমেটিক আতঙ্ক ঢুকে যাবে যে গণতন্ত্র দিলেই ইসলামপন্থিরা ক্ষমতায় চলে আসবে! আগে একদলীয় শাসন ছিল ইন্ডিয়ার প্রয়োজনে, এখন আসবে দৃশ্যত পশ্চিমা বিশ্বের প্রয়োজনে। ইসলামপন্থিদের প্যাম্পারিং এ কারণেই বোধহয় শুরু হয়ে গেছে।
কাজেই পিনাকীদা এবং ইলিয়াস হোসাইন প্রমুখের উদ্দেশে বলছি, চলার পথে আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকবেই। কেউ একটি গ্লাসকে অর্ধেক ভরা দেখব, কেউ অর্ধেক খালি দেখব। বিএনপির অনেক দোষত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পিনাকীদা এ দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক কালচার সম্পর্কে আমার চেয়েও ভালো জানেন। বিএনপি একটি ক্ষমতাকেন্দ্রিক বুর্জোয়া দল, কোনো আদর্শিক দল নহে। সেই দল থেকে রাতারাতি সব ফেরেশতা বের হয়ে আসবে, সেটা আমরা কখনোই আশা করতে পারি না। কাজেই পিনাকীদার মতো অনেকেই হয়তো বেশি আশা করে এখন হতাশ হয়ে পড়ছেন। বিএনপি আমাদের জন্য বা দেশের জন্য এই মুহূর্তে কী করতে পারবে, কতটুকু করতে পারবে, তা আগে নির্ণয় করা দরকার।
একটা সিস্টেম বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবার দাঁড় করানোর নিমিত্তে বিএনপিকে এই মুহূর্তে দরকার। একটা শক্ত ভিতের ওপর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দাঁড় করাতে পারলেই ভবিষ্যতে কোনো নিষ্পাপ ফেরেশতা দলের পক্ষে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসা সম্ভব হবে। কাজেই কিছুটা পাপী-তাপী দিয়েই আপাতত এগিয়ে যেতে হবে।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে কি আমি এসব অনিয়মের পক্ষে ওকালতি করছি?
বিএনপির টপ নেতৃত্ব বিশেষ করে অ্যাক্টিং চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কিছু প্রচেষ্টার দিকে পিনাকীদার সদয় দৃষ্টি এড়ানোর কথা না । বিএনপি নেতাকর্মীদের একধরনের ট্র্যাপে ফেলানো হয়েছে কিংবা অনেকে নিজেরাই তাতে পড়ে গেছেন। অ্যাক্টিং চেয়ারম্যানের হাতে যে ক্ষমতা এখন রয়েছে, তার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করে তিনি পথভ্রষ্ট নেতাকর্মীদের নিবৃত করতে চেষ্টা করছেন। এ রকম শাস্তিপ্রাপ্ত নেতাকর্মীর সংখ্যা ইতোমধ্যে কয়েক শ ছাড়িয়ে গেছে। এসব বিতর্কিত তবে লোভনীয় কাজকর্ম থেকে নেতাকর্মীদের বারণ রাখতে দলীয় শাস্তির সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনিক বা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার দল বা তার অ্যাক্টিং চেয়ারম্যানের হাতে নেই। বরং এই এখতিয়ার যাদের হাতে তারা বিএনপিকে খারাপ হিসেবে প্রতিপন্ন করার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে আছে। এখান থেকে অবশ্যই আশা করা যায় আমরা কিছুটা নতুন বিএনপিকে দেখতে পাব। কাজেই গুটিকয় নেতাদের হঠকারিতামূলক মন্তব্যে হতাশ না হয়ে এই বিষয়টি একটু দরদের সঙ্গে দেখা উচিত।
একজন চরম আশাবাদী মানুষ হিসেবে বিএনপির ইন্টারনাল সংস্কারের জন্য আমার নিজের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। এ রকম তিনটা মেসেজ গত ১০ জানুয়ারিতে আমি অ্যাক্টিং চেয়ারম্যান বরাবর দিয়েছি। একান্ত ব্যক্তিগত যোগাযোগ হলেও বিষয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ভেবে এখানে প্রকাশ করলাম।
‘ভাইয়া, বর্তমান এই চ্যালেঞ্জকে আরো বুদ্ধিমত্তা ও ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করা উচিত। আমাদের ন্যাশনাল সাইকিতে এন্টি ইন্ডিয়ান মনোভাব আরো শক্তভাবে গেড়ে বসেছে। ইন্ডিয়া বা আওয়ামী লীগ বিষ খাইয়ে মারতে পারে নাই, এবার মিঠাই খাইয়ে মারার পরিকল্পনা নিয়েছে। আপনাকে অনুরোধ করব, ইন্ডিপেন্ডেন্ট এবং গোপন একটা টিম দিয়ে অনুসন্ধান করুন কারা কারা বিএনপির নাম ভাঙিয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে গেছে। আর যেকোনো সমালোচনাকে নিজেদের কারেকশনের জন্য ব্যবহার করা উচিত। তাতে আখেরে বিএনপির লাভ হবে।’
অ্যাক্টিং চেয়ারম্যানের সঙ্গে পিনাকীদার নিজেরও যোগাযোগ ছিল। আমার মতো একজন নগণ্য মানুষের অপ্রিয় সমালোচনা বা পরামর্শের প্রতি উনি দৃষ্টি দেন বা প্রয়োজনমতো সাড়া দেনÑএটাও আমাকে আশাবাদী করেছে।
সব শেষে পিনাকীদাকে বলছি, আপনার প্রত্যাশার মতো বিএনপি উৎকৃষ্ট না হলেও এখনকার আশঙ্কার মতো হয়তোবা এত খারাপ হবে না। কাজেই বিএনপির প্রতি আপনার পরামর্শ ও সমালোচনা অব্যাহত রাখুন। শুধু খেয়াল রাখবেন, এখানেও আপনার ছোট ভ্রাতা-ভগিনী যারা রয়েছেন, তারা যেন বেশি কষ্ট না পান।