জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল প্রশংসনীয়। শিক্ষার্থীদের চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি থেকে শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের পতন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে সমন্বয়কদের ডাকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা বাঁধভাঙা সাড়া দিয়েছিলেন। আন্দোলনে যোগ দিতে লাখো নারী নেমে এসেছিলেন রাজপথে। নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। নির্ভয়ে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছেন। পুরুষের পাশাপাশি মায়েরা তাদের সন্তানের সুরক্ষায় যেভাবে সাহসের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছিলেন, সেটাও ছিল অভূতপূর্ব। স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের এক দফা আন্দোলনে সেদিন জীবনের মায়া ত্যাগ করে শত শত মা রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আমরা নারীদের স্বতঃস্ফূর্ততা দেখেছি। চরম দুঃসময়ে সহায়তার হাত বাড়াতে দেখেছি, আহত হতে দেখেছি, শুশ্রূষা করতে দেখেছি।
আমরা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে পড়েছি, মায়েদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেক তরুণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এবারের বিপ্লবে দেখেছি তার বিপরীত চিত্র। সন্তানদের সাহস জোগাতে, তাদের অধিকার আদায় করতে এবং নিরাপত্তা দিতে মায়েরা পুলিশের মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছিলেন। বুক চিতিয়ে প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছেন। অনেক নারীশিক্ষক তাদের ছাত্রদের বাঁচাতে অভিভাবক হয়ে মাঠে দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের সাহসী উচ্চারণ সেদিন আরও অনেক নারীকে আন্দোলনে শামিল করেছিল।
নুসরাত জাহান টুম্পা নামে আন্দোলনরত এক শিক্ষার্থী পুলিশের প্রিজন ভ্যানের পথ রোধ করে একা দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার চোখে চশমা ও কাঁধে ব্যাগ সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনে সাহসিকতার অন্যতম এক প্রতিচ্ছবি। জুলাইয়ের শেষদিন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের দেওয়া কর্মসূচি ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ সফল করতে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন সেই আন্দোলনে। হাইকোর্টের সামনে জড়ো হতেই পুলিশের অতর্কিত হামলা। হাইকোর্ট এলাকা থেকে নূর আলম হাসানকে পুলিশ ধরে নিতে চাইলে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাইকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রিজন ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন নুসরাত। তাকে শক্তহাতে জড়িয়ে ধরে প্রতিরোধ করেন তিনি। সাহসী এই তরুণী চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আমার ভাইকে ধরে নিয়ে যেতে হলে আমার লাশের ওপর দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমার ভাইকে ছেড়ে না দেওয়া পর্যন্ত আমি এখান থেকে এক ইঞ্চিও নড়ব না।’
নুসরাতের সেই অদম্য সাহসিকতার গল্প দেশের অনেকেরই জানা। নুসরাতের সাহসিকতায় সেই সময় আটক হওয়া শিক্ষার্থী নূর আলমও বিস্মিত হন। তিনি বলেন, ‘নুসরাতের মতো এমন সাহসী বোনদের জন্যই বাংলাদেশ দেখেছে এক নতুন সূর্য। সেদিন সে আমাকেই শুধু অবাক করেনি, পুরো বাংলাদেশ এবং সারা বিশ্ব তার সাহসিকতায় বিস্মিত হয়েছে।’
২০২৪ সালের ২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিভাগের শিক্ষিকা ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌসের প্রতিবাদী কণ্ঠ শুনেছি। তিনি বলেন, ‘আমার ছাত্রের মুখ চেপে ধরার সাহস কে দিয়েছে আপনাদের?’ ‘আমার ছাত্রের কলার ধরার সাহস কে দিয়েছে আপনাদের?
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তোমরা ভয় পেয়ো না। শিক্ষক হিসেবে আমরাও তোমাদের পাশে আছি। যত দিন না আমাদের শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি সরকারের পক্ষ থেকে মেনে নেওয়া না হয়, তত দিন তোমাদের সঙ্গে মাঠে আছি, মাঠে থাকব।’
হাজারো মা সেদিন পথের ধারে পানি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের পানি পান করিয়েছেন। বহু মাকে দেখেছি ভাত মেখে রাস্তায় দৌড়ে দৌড়ে শিক্ষার্থীদের মুখে ভাত তুলে দিতে।
আমরা এই পুরো আন্দোলনে এমন হাজারো চোখভেজানো দৃশ্য দেখেছি। সন্তানদের নিরাপত্তার জন্য তাদের পাশে দাঁড়াতে এবং আন্দোলনে তাদের শক্তি জোগাতে নিরন্তর চেষ্টা করেছিলেন আমাদের মায়েরা। দেখেছি, সন্তান কোলে মায়েদের পতাকাহাতে উল্লাস। ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে মায়েদের এভাবে ব্যাকুল হয়ে অংশগ্রহণ করার মতো ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আগে কখনও দেখা যায়নি।
নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব পালন করার সময় হামলার শিকার হন গণমাধ্যমকর্মী সামিমা সুলতানা লাবণি। তবুও দমে যাননি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিউজ কাভার করেছেন।
ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী শিরিন ও নাবিলা বলেন, ‘আমরা দুজন মেয়ে গভীর রাতে মুঠোফোনের ছোট লাইটের আলো জ্বালিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া আমাদের ভাই-বোনদের অনুপ্রাণিত করতে দেয়ালে গ্রাফিতি করতাম। পুলিশ টহল দিতে এলে আমরা ঘাসে শুয়ে পড়তাম। এভাবে আমরা মেয়েরা এই আন্দোলন সফল করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে যার জায়গা থেকে কাজ করেছি।’
চিকিৎসক অরচি ছাত্র-আন্দোলনের দিনগুলোয় পেশাগত জায়গার দায়বদ্ধতা থেকে নিজ বাসার গ্যারেজে আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দশম শ্রেণির ছাত্রী সামিয়া অংশ নেন। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ভবিষ্যতেও একইভাবে নামবেন নারীরা।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম বলেন, ‘নারীদের অংশগ্রহণ অভূতপূর্ব ছিল। সবাই নিজের বোনের মতো সবার পাশে থেকেছে। আমি যতদূর দেখেছি, সবাই খুবই আগ্রহী ছিলেন সমতার সংগ্রামটা সফল করার জন্য।’
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওমামা বলেন, আন্দোলনে নারীদের সমান ভূমিকা থাকলেও পরে তাদের অবদানের কথা কেউ মনে রাখেনি।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক মাইশা মালিহা বলেন, ‘আমাদের ওপর যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়েছে, আমরা দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেছি। সেখান থেকে বাঁচার আর উপায় ছিল না। মেয়ে হিসেবে কোনো ছাড় পাওয়া যায়নি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের হল সমন্বয়ক আদিবা সায়মা খান বলেন, ‘আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছিলাম নিরস্ত্র। আমরা আমাদের যৌক্তিক দাবি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। ইটপাটকেল দিয়ে মেয়েদের আঘাত করা হচ্ছে, মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হচ্ছে—এ ধরনের দৃশ্য দেখার ট্রমা থেকে এখনও বের হতে পারিনি।’
আন্দোলনে নারীরা যখন কলমযোদ্ধা
অনেক নারী প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে কলম ধরেছিলেন। আন্দোলনের সূত্র ধরে সাহিত্যিক, সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও আইনজীবী অনেকেই স্বৈরশাসকের রোষানলে পড়েছিলেন। অনেককে আহত, এমনকি হত্যা ও গুমের শিকার হতে হয়েছে। নারীদের ওপর হামলার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলনে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং তা আরও বেগবান হয়ে ওঠে। শেষের দিকে বাংলাদেশের সর্বস্তরের নারীসমাজ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে পুলিশের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে সন্তানসম ছাত্রদের সামনে এক ধরনের রক্ষাপ্রাচীর তৈরি করেন।
এভাবে ৯ দফা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একপর্যায়ে এক দফা সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হয়। দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলনের মাথায় সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয় এবং সরকারপ্রধান দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।